''অভিমান জমে জমে আমি ব্যথাহীন"
||৯||
"দিদিভাই, তুই সত্যিই শাড়ি পরে যাচ্ছিস তোদের রিইউনিয়নে?"- দিদান চোখ বড় বড় করে বলল।
"আর কি পরবো?"- মুখে একটা ফেস মাস্ক লাগিয়ে এসে আমি বিছানায় দিদানের পাশে বসলাম।
"কেন রে? আজকালকার মেয়েরা কতরকম জামাকাপড় পরে। তুই ওইসব পরিস না কেন? কত সুন্দর সুন্দর স্কার্ট আছে.. ওয়ান পিস না কিসব বলে..."
-দিদান মুখ থেকে ম্যাগাজিনটা নামিয়ে বলল।
"ধুর! আমার ওইসবে একদম কমফোর্টেবল লাগে না। তার চেয়ে বরং শাড়ি ভালো।"- আমি দিদানের দিকে ঘুরে বললাম। কাল কলেজ থেকে ফেরার পথে তোজো মনে করিয়েছিল। আমাদের স্কুলের রিইউনিয়নের কথা। ঋভু দাকে বলার আগে ও নিজেই বলেছিল - "রেডি থেকো। অফিস থেকে ফিরে we will go together."
বিকেল ৫টা বাজে। ৬.৩০টার মধ্যে বেরোনোর কথা। ঋভু দা এখনো ফেরেনি...রায়া পিসির সাহায্য নিয়ে শাড়িটা পরে ফেললাম। সাজগোজ আমি কোনোদিনই করতে পারি না। রায়া পিসিই একটা ঢিলে খোঁপা করে দিল। চোখে একটু মোটা করে কাজল পরলাম। গাড়ি বারান্দায় শুনতে পেলাম ঋভু দা বাইক রাখতে রাখতে লাল দার সাথে কথা বলছে। দিদান আমার ঘরের জানলা দিয়ে উঁকি মেরে বলল- "দাদাভাই এসে গেছে। ও হরি দা! হরি দা!"- হরি-কার নামজপ করতে করতে দিদান ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। ঋভু দা দিদানের সাথে কথা বলে উপরে উঠে এল। আয়না থেকে মুখ সরাতে সরাতে মনে হল ঋভু দার চোখদুটো আমার দিকে তাকিয়ে। দরজার দিকে তাকাতেই দেখলাম কেউ নেই। মনের ভুল হয়তো...!
ঋভু দা নীচে যাওয়ার আগে ঘরের দরজায় এসে নক করে বলল- "are you done?"
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম ৬.৩০টা।ঋভু দা বরাবর পাঙ্কচুয়াল। আমি দরজাটা খুলে বাইরে আসতেই ল্যাভেন্ডারের গন্ধ পেলাম। ঋভু দা তাহলে আফটার শেভটা মেখেছে! ও আমার দিকে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ। কি যেন একটা ভাবল তারপর বলল -"এদিকে এস।" আমার হাত ধরে ঘরে নিয়ে এল ও। আয়নার গা থেকে একটা মেরুন রঙা টিপ খুলে আমার কপালে পরিয়ে দিয়ে বলল- "look!" ঋভু দার গা থেকে ডিও আর আফটার শেভের সাথে সিগারেটের একটা মিশেল গন্ধ আসছে। রুহি বলে এইটা একটা "appealing essence" ভাই!
"কি হলো? আরে আমায় না! নিজেকে দেখো।"- ঋভু দা আমাকে আয়নার দিকে ঘুরিয়ে আমার কাঁধে থুতনি রাখল। একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল ও আমার দিকে। ওর নীল চোখদুটো কথা বলছিল। সম্মোহনী মন্ত্র পড়ছিল বোধহয়। ঋভু দা ওর মুখে একটা নরম হাসি ছড়িয়ে বলল- "Perfect!"
দিদানের ডাকাডাকিতে সিঁড়ি দিয়ে নেমে এলাম আমরা। আমার হার্টবিট বেড়ে গেছে। দিদান আমার দিকে তাকিয়ে বলল- "এই দিদিভাই দারুন দেখাচ্ছে তো তোকে! দাঁড়া ,একটা ছবি তুলি। এই দাদুভাই তুই ওর পাশে দাঁড়া তো।"
দিদানের ছবি তোলা হয়ে গেলে বাইরে এলাম আমরা। ঋভু দার একটা ফোন আসায় আমি এগিয়ে এলাম। দেখলাম গেটের কাছে হেলান দিয়ে তোজো দাঁড়িয়ে আছে। আমায় দেখতে পেয়ে সোজা হয়ে বলল- "ভাই আজ তো কারুর ব্যাটারি খরচ হবেই হবে। তুই তো চমকাচ্ছিস!"
ঋভু দা কল কেটে বাইরে এলো। আমাকে কিছু বলতেও যাচ্ছিল, কিন্তু তোজোকে দেখে চুপ করে গেল। ঋভু দা আজ একটা কালো টাক্সিডো পরেছে। জুড ল যদি বাঙালি অরিজিনের হত,আর বাংলায় কথা বলত তাহলে বোধহয় অনেকটা এরকম দেখাতো। তোজোর মুখে একটা আলগা শীতলতা খেলে গেল ঋভু দাকে দেখে। আমার কাঁধে হাত রেখে তোজো ফিসফিস করে বলল-"ডিলান রেগে যাচ্ছে ভাই। আমি কাটি। একবার মালবিকার সাথে দেখা করতে হবে।"
তোজো চলে গেলে আমরা গাড়িতে উঠলাম। আজ ঋভু দাই ড্রাইভ করছে। লাল দার মেয়ের জন্মদিন তাই দাদুন ছুটি দিয়েছে।
স্কুলের সামনে পৌঁছে ঋভু দা গাড়িটা পার্কিং লটে দাঁড় করাল। পুরো রাস্তাটা ঋভু দা একটাও কথা বলেনি। চুপ করেছিল। গাড়িটা পার্ক করেও আমরা গাড়ির মধ্যে বসে রইলাম। ঋভু দা একটু গম্ভীর হয়েই বলল- "মিতুল, That girl Malabika , তোজো ওকে পছন্দ করে ?"
"হ্যাঁ। কিন্তু হঠাৎ এই..."-আমার কথাটা শেষ হওয়ার আগেই ঋভু দার ঠোঁটের কোণে হাসি খেলে গেল।
আমি সিটবেল্টটা খোলার চেষ্টা করেও খুলতে পারলাম না। ঋভু দা আমার দিকে ঝুঁকে সিটবেল্টটা খোলার চেষ্টা করল। ঋভু দা আমার অনেকটা কাছে। আমার হৃদস্পন্দন বাড়ছে ঢিমেতালে। ঢিপ ঢিপ ঢিপ।
"Mitul, are you okay?"-ঋভু দা নিজের সিটে ফিরে গিয়ে জিজ্ঞেস করল।
"হ্যাঁ!"-আমি নিজেকে সামলে নিলাম।
গাড়ি থেকে বেরিয়ে স্কুলের অডিটোরিয়ামে এলাম আমরা। এইখানেই আজকে অনুষ্ঠান। ঋভু দাকে দেখতে পেয়ে অভ্রনীল দা এগিয়ে এল। অভ্র দা এসেই ঋভু দাকে জড়িয়ে ধরে বলল- "Guys, Our Most handsome Man is here." আমার দিকে তাকিয়ে ও হাসতে হাসতে বলল- "Is it You, Prez?" স্কুলে পরপর দুবছর স্টুডেন্ট প্রেসিডেন্ট ছিলাম আমি। সেটা আমি প্রায় ভুলতে বসলেও আজ এখানে এসে মনে পড়ে গেল। অভ্র দা এরপর ঋভু দাকে ছেড়ে আমার পাশে এসে বলল- "You are looking gorgeous, Aahir." তখনই স্টেজ থেকে ঘোষণা হলো ডান্স শুরু হওয়ার কথা। এইটা আমাদের স্কুলের চিরায়ত প্রথা। কোলকাতার এক নামি ইংরেজি মাধ্যম তার উপর খ্রিষ্টান স্কুল। ঘোষণা শুনেই অভ্র দা আমার সামনে হাত পেতে বলল- ''May i have this dance? নাকি আজকেও বলবে I can't dance!"
কথাটার মধ্যে লুকিয়ে থাকা খোঁচাটা আমি বুঝতে পারলাম। অভ্র দা স্কুলের হার্টথ্রবদের মধ্যে একজন হলেও আমার ওকে কোনোদিন ভালো লাগত না। স্টুডেন্ট কাউন্সিলে ওর নামে প্রচুর কমপ্লেন আসত।
মিউজিক বাজতে শুরু করলেই অভ্র দা আমার হাত ধরে নাচতে শুরু করল। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম ঋভু দা আর পামেলা দি একসাথে। পামেলা দি আমার দিকে তাকিয়ে মুখ ভ্যাঙালো। দ্বিতীয় রাউন্ডে পার্টনার পরিবর্তন হতেই ঋভু দা আমার হাত ধরল। ওর গায়ে থেকে পামেলা দির পারফিউমের একটা আলতো গন্ধ বেরোচ্ছে। আমি মাথা তুলে ঋভু দার মুখের দিকে তাকালাম। পামেলা দির সাথে নাচার সময় ওর মুখটা অন্যরকম ছিল। এখন তো একটা আলতো হাসি লেগে আছে। গান বন্ধ হলে আমি একটা চেয়ারে গিয়ে বসলাম। অরুন্ধতী, তমোনাশ আর আমার ব্যাচের লোকজন আশেপাশে ছড়িয়ে ছিল। অরুন্ধতী আমায় দেখতে পেয়ে এসে জড়িয়ে ধরে বলল- "ভাই, খবর কি? স্কুল শেষ বলে বন্ধুত্ব শেষ নাকি?" তোজোও কোথা থেকে এসে আমার পাশে বসে ফিসফিস করে বলল- "টাক্সিডো কি খেল দেখাচ্ছে মাইরি! অফ শোল্ডার একদম চিপকে গেছে!" ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে দেখলাম ঋভু দা আর পামেলা দি কথা বলছে।
স্টেজ থেকে অ্যাঙ্কার বলল- "So here's the request from the audience. Please welcome Mr.Writobaan BasuRoy" ঋভু দা স্টেজে উঠে ভায়োলিনটা তুলে নিল। ও ভায়োলিনটা বড্ড ভালো বাজায়। দাদুন বলে ভায়োলিনটা ঋভুর সোল ইন্সট্রুমেন্ট!
ও স্টেজ থেকে নামতেই পামেলা দি ওর হাত ধরে টানতে টানতে কোথায় নিয়ে গেল। তোজো আমার পাশে বসে হাসতে হাসতে বলল- "ভাই, ডিলান তো হাতছাড়া হয়ে যাবে। কিছু কর!" আমি তোজোর দিকে তাকালাম। আমার সত্যিই আর ভালো লাগছিল না! ঋভু দা কি সব জেনেশুনেও এরকম করবে! ও কি পামেলা দির মোটিভ বুঝতে পারছে না!
"ক্যাজ ভাই ক্যাজ! আমি মজা করছি। আচ্ছা আয় আমার সাথে।" -তোজো আমার হাত ধরে ঋভু দারা যেইদিকে গেছে নিয়ে চলল।
"তো-তোজো... এটা কি ঠিক হবে...মানে ..."
কথা বলতে বলতে আমরা স্কুলের বাগানের দিকে চলে এলাম। দেখলাম পামেলা দি ঋভু দাকে জড়িয়ে ধরেছে। আর ঋভু দা ওর মাথায় হাত বোলাচ্ছে। ঋভু দাকে ডাকতে গিয়েও আমার গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোলো না।বুকের ভিতরটা যেন দুমড়ে মুচড়ে দিচ্ছিল কেউ। কেন! কেন ঋভু দা! আমার অজান্তেই কাঁদছিলাম আমি। তোজো এসে পিছন থেকে আমার চোখটা চেপে ধরল তারপর গম্ভীর স্বরে বলল- "দেখিস না ওইদিকে।"
তোজোর গলার আওয়াজে ঋভু দা চমকে উঠল। আমাকে দেখতে পেয়ে পামেলা দিকে সরিয়ে এগিয়ে আসতে চাইল। আমি আর পারছিলাম না এই দৃশ্য দেখতে। দৌড়াতে শুরু করলাম আমি। পিছন থেকে কানে ভেসে এল ঋভু দার স্বর..."মিতুউউউল!" আর তোজোর উত্তর "শালা betrayer!" কিছু ভালো লাগছিল না আমার। তোজো আমার পিছন পিছন দৌড়াতে দৌড়াতে এসে আমায় ধরে ফেলল। স্কুলের গেটের বাইরে তেমন ভিড় নেই। স্কুল থেকে একটু এগিয়ে একটা গলির ভিতরে ছোট একটা পার্ক আছে। তার পাশেই চা সিগ্রেটের দোকান। তোজো পার্কের বেঞ্চে আমায় বসিয়ে এক বোতল জল কিনে এনে আমার পাশে বসে বলল- "কাঁদতে পারিস। কাঁদ! আমি আছি।"
তোজোর জামার হাতা ধরে আমি কেঁদে চললাম। এ আমার কতদিনের জমে থাকা অভিমান? কয়েকদিন? কয়েক মাস ? নাকি কয়েক বছরের?
Comments
Post a Comment