My Only One 🌻

                     ||৬||

             

"দাদুন, attic এর অবস্থাটা কেমন? I was thinking about setting up my workshop there."--ঋভু দা কফিতে একটা লম্বা চুমুক দিয়ে বলল।

অক্সফোর্ড থেকে আর্কিটেকচার নিয়ে পড়াশোনা করেছে ঋভু দা। দাদুনের কাছে শুনেছি ওখানে টপ স্টুডেন্টদের মধ্যে একজন ছিল ও। ঋভু দা পড়াশোনায় বরাবরই ভালো। শুধু পড়াশোনা নয়, টেনিস, সাঁতার ,দাবা তিনটেতে আমাদের স্কুলকে রিপ্রেজেন্ট করতো ও। স্কুলে বহু প্রাইজ রয়েছে ওর নামে। অথচ ঋভু দা'কে দেখলে কেউ সেটা বুঝতেই পারবে না। ওর আশেপাশের চেনা কয়েকজনের গন্ডি পেরিয়ে ঋভু দা কারুর সাথে কথা বলে না। স্কুলে সবাই ওকে নাকউঁচু বলত। আমার মনে পড়ে, স্কুল শেষ হলে ঋভু দা গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করত কানে হেডফোনস গুঁজে।দূর থেকে ওকে একটা শান্ত উইলো গাছের মতন লাগত। গাড়িতে উঠে আমাদের দু-একটা কথা হত। ভ্যালেন্টাইনস ডে-তে ঋভু দা'র টেবিলে প্রচুর ক্যাডবেরি আর গিফ্টস জমতো। ঋভু দা সেগুলো সব নিয়ে স্কুলের দারোয়ান কাকুর বাচ্চাদের দিয়ে দিত। ঋভু দা একইরকম রয়ে গেছে। শুধু ওভার দ্য ইয়ার আমাদের মাঝের বরফ গলেছে।

"দিদিভাই!"-দাদুনের ডাকে আমি আবার 'আজ'এ ফিরে এলাম। 

"বলছি দুদিনের জন্যে আমি আর তোর দিদান তারাপীঠ যাচ্ছি। তুই তো বলেছিলি যেতে পারবি না। ঋভু বলছে চিলেকোঠার ঘরটাতে ওয়ার্কশপ বানাবে। তুই একটু হরির সাথে লোকজন লাগিয়ে ওকে একটু হেল্প করে দিবি?"

"আচ্ছা। বেশ! তুমি এইবার চা-টা শেষ করো। দিদান এসে দেখলে কিন্তু সন্ধ্যে ৮টার চা বন্ধ।"--আমি হাসতে হাসতে বললাম। ঋভু দা'র দিকে আড়চোখে তাকালাম আমি। ঋভু দা মিটিমিটি হাসছে। ওর চোখ আমার দিকে। 

"হাহাহা! যা বলেছিস। তোর দিদান কিরকম একটা হিটলার মার্কা হয়ে যাচ্ছে।"-দাদুন জোরে হেসে উঠল।

"হ্যাঁ! সেই তো! এরপর যখন গন্ডায় গন্ডায় ওষুধ গিলবে তখন শান্তি হবে তোমার।" - দিদান ঠাকুরঘরের দরজাটা বাইরে থেকে বন্ধ করতে করতে বলল। ঠাকুরঘরের লাগোয়া লম্বা বারান্দাতেই একটা ছোট হলুদ ঝাড়বাতি লাগানো। তার ঠিক নিচেই একটা শ্বেত পাথরের ভারী টেবিল আর চেয়ার পাতা। ওখানে আমরা সন্ধ্যেবেলা বসে চা খাই। গল্প শুনি। ৮টা বাজলে দাদুন স্টাডির দিকে চলে যায়। দিদান ঘরে বসে টিভি দেখে। আমি পড়াশোনা করি বা একটু পিয়ানো বাজাই। হরি-কার নেতৃত্বে রায়া পিসি আর চিনু কাকা রান্না করে। 

"কি? আমি গন্ডা গন্ডা ওষুধ গিলি? দেখ গিন্নি সব কথাকে এরকম ঝগড়ার টপিক বানিয়ে ফেলো না !"-দাদুন ব্যাজার মুখে বলল। দিদান একটা চেয়ার টেনে বসে একটু দম নিল। গত দেড় ঘন্টা ধরে গোপালসেবা করা কি মুখের কথা!

"এই বুড়ো! যেটা আসল কথা সেটা বলেছ?"- দিদান চোখ পাকিয়ে বলল।

"কোন আসল কথা?''- দাদুন অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো।

"দাদুভাইকে..."- দিদানের পুরো বাক্য শেষ হওয়ার আগেই দাদুন buzzer  প্রেস করার মতন টেবিল চাপড়ে বলল -"yes! মনে পড়েছে। থ্যাংক ইউ ডা--ইয়ে গিন্নি!"

ঋভু দা মিটিমিটি হেসেই যাচ্ছে। কফি শেষ করে বলল- "আমাকে? কি কথা? "

দাদুন একটু গম্ভীর হয়ে বলল- "শোনো, my child! I want you to join my company as an architect. I mean I happen to have a vacant place. তাই বলছি। তবে একদম ইন্টার্ন থেকে শুরু করতে হবে। তোমায় অভিজ্ঞতা তৈরি হওয়া দরকার!" - কথা শেষ করে দাদুন ঋভু দা'র মুখের দিকে তাকাল। এইবার উত্তর শোনার পালা। 

"Roger that!"- ঋভু দা হেসে বলল। এই হাসিটা পূর্ণ দৈর্ঘ্যের হাসি! 

"তাহলে পরের মাসে আমাদের ইন্টারভিউ আছে। আটেন্ড কোরো।"- দাদুন পাইপে তামাক ভরতে ভরতে বলল। তারপর ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল- "আমার বই পড়ার সময় হয়ে গেছে। আমি চললাম। বলছি গিন্নি আরেকবার একটু..."

"বুঝেছি! যাও। "-দিদান মুখ বেঁকিয়ে বলল। দাদুন পাইপ টানতে টানতে স্টাডিরুমে চলে গেল।

দিদান আঁচল থেকে চাবির গোছা বের করে আমার হাতে দিয়ে বলল- "দিদিভাই তুই দাদুভাইকে চিলেকোঠার ঘরটা দেখিয়ে দে তো। আর হ্যাঁ রে দাদুভাই রাতে ভাত খাবি তো? মাংস রান্না করছি।"

"হ্যাঁ হ্যাঁ। যা করবে খাব।" - ঋভু দা উঠে দাঁড়াল। 

‌দিদান নীচে নেমে গেলে আমরা সিঁড়ি বেয়ে চিলেকোঠার ঘরের সামনে এলাম। আমি চাবি দিয়ে ঘরটা খুলে ভিতরে ঢুকলাম। ঋভু দা এখনো দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। ওর চোখ ঘরের দেওয়ালে আঁকা নীল সমুদ্র আর লাইট হাউসের দিকে। ছবিটা আইরিনের আঁকা। এই ঘরটা ওর খুব প্রিয় ছিল। আমি টেবিলে রাখা ল্যাম্পশেডটা জ্বালালাম। পার্ক স্ট্রিট থেকে দিদান কিনে এনেছিল।ঘরটায় এখন সুন্দর তারারা ঝলমল করছে। 

‌"মিতুল!"-ঋভু দাকে গম্ভীর শোনাল।

‌"ও! সরি সরি! আমি জাস্ট"- আমি ল্যাম্পশেডটা বন্ধ করতে যেতেই ঋভু দার হাতের ছোঁয়া লাগল আমার হাতে। ও চেয়ে আছে আমার দিকে। ওর গোটা মুখে তারারা খেলা করছে। তার মধ্যে নীল চোখদুটো বড্ড উজ্জ্বল। আমার কোমর থেকে ভারী হয়ে যাচ্ছে। ঋভু দা ওরকম অবাক হয়ে কি দেখছে? ওর উষ্ণ হাতের ছোঁয়ায় আমার ভিতরে বরফ গলছে। 

‌"ঋ-ঋ-ভু দা"-আমার গলার স্বরটা কেঁপে উঠল যেন। 

‌"yes. I know!"- ঋভু দা আমার মাথায় হাত রাখল। আমার গলা অব্দি একটা জমে থাকা অনুভূতি কান্না হয়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে। 

হঠাৎই আমার হাতের ছোঁয়ায় ল্যাম্পশেডটা অফ হয়ে গেল। আমরা চমকে সরে গেলাম । ঋভু দা ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আগে একবার থমকে দাঁড়াল। ওর গলার স্বরে এখন পাহাড়ি ঝর্ণা। বলল- "মিতুল। i need to buy some stuffs. Do you think you can make some time tomorrow ?"

"হ-হ-হ্যাঁ!"- আমি উত্তর দিলাম। ঝড় থেমে গেছে আমার ভিতরে। বড্ড উষ্ণ লাগছে আমার। ঋভু দা ঘাড় ঘুরিয়ে একবার তাকাল আমার দিকে তারপর সোজা নেমে চলে গেল সিঁড়ি দিয়ে। ওর মুখটা এক আকাশ রোদ্দুরের মতন ঝলমল করছে!

‌