বৃষ্টি তোমাকে দিলাম 🌻
||৪||
আয়নার সামনে এসে দাঁড়াতেই মাথার পিছনে ঘড়িটার দিকে চোখ গেল আমার। আর মাত্র দু ঘন্টা! তারপরেই ঋভু দা.... আমার ভিতরে আজ যেন কিরকম হচ্ছে! উচ্চমাধ্যমিকের রেজাল্টের বেরোনোর দিনেও তো এরকম হয়নি। আনন্দ হচ্ছে। ভয় করছে। একটা ঠান্ডা ফ্লুইড বারবার নেমে যাচ্ছে আমার স্পাইনাল কর্ড বেয়ে। আয়নার দিকে চোখ গেল আবার। আমায় ভালো লাগছে? তোজো থাকলে এক্ষুনি বলত,"ভাই তুই এইরকমভাবে তাকালে আমি বাদে যেকোনো ছেলে কাত হয়ে যাবে!" দাদুন কখন থেকে লাল দার উপর চিৎকার করে যাচ্ছে। আমার কিছুই ভালো লাগছে না! মনে হচ্ছে কতক্ষণে ঋভু দা'র মুখটা দেখতে পাব......
"মিতুল! মিতুল!"- নিচ থেকে দিদান ডাক দিল।
"আসি।''- উত্তর দিয়ে আমি আরেকবার আয়নায় নিজেকে দেখে নিলাম চট করে। না! আর পারছি না অপেক্ষা করতে আমি...
সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে শুনলাম দাদুন বলছে-"আজকেই একটা এক্সট্রা ড্রাইভার দরকার ছিল। আর আজই... লাল তুই কোনো কাজের না!"
লাল দা কাঁচুমাচু মুখ করে কিছু বলতে যেতেই দাদুন ওর দিকে কটমট করে তাকালো। দিদান দাদুনের দিকে কটমট করে তাকালো। আমি ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে না পেরে রাফিকি হরি-কার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। তারপর চাপা গলায় জিগ্যেস করলাম- "ব্যাপারটা কি? এইরকম সন্ধ্যেবেলায়..."
"বাবুর আজ রায়সাহেবের মেয়ের বিয়েতে নেমন্তন্ন। ওই জন্যে আরেকটা ড্রাইভার দরকার ছিল। গিন্নি মা বলছে বিয়েতে না যেতে। আর বাবুও বলছে এটা এড়ানো যাবে না। লাল দা ড্রাইভার ব্যবস্থা করতে পারেনি।"-- রাফিকি হরি কা চোখদুটো আধো বুঁজে বলে গেল।
"এই বুড়ো! তোমায় আমি কবে থেকে বলছি লালের উপর চাপ পড়ছে বড্ড! আরেকটা লোক রাখো। সেটা তুমি শুনবে না! বোঝো এখন! আর রায় দা'র মেয়ের বিয়ের কথা তুমি ভুলে যাও কি করে! এই বন্ধু তুমি? যত্তসব!"-- দিদান রাগে গরগর করতে করতে বলল।
"দেখ গিন্নি..."-দাদুন কিছু বলতে যেতেই আমি পিছন থেকে বললাম - "আমি একটা কথা বলতে চাই। শুনবে?"
চার জোড়া চোখ আমার দিকে ঘুরে গেল। রাফিকির চোখ খুলে গেছে। লাল দা'কে দেখে মনে হল ও যেন ডুবতে ডুবতে কিনারা খুঁজে পেয়েছে। দাদুন আর দিদান পরবর্তী ডিবেটের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে।
"আমি আর দাদুন একসাথে এয়ারপোর্ট অব্দি যাই। ঋভু দাকে পিক করে নিয়ে আমরা দাদুনকে রায় জেঠুর ওখানে নামিয়ে দেব। লাল দা আমাদের বাড়ি অব্দি ছেড়ে দিয়ে তারপর দাদুনের কাছে ব্যাক করে যাবে।" -পরিস্থিতি সামাল দেওয়া গেছে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল লাল দা।
''ঠিক আছে।দিদিভাই তুই গিয়ে গাড়িতে বস। আমি আসছি।" - দাদুন দিদানের সামনে টাই হাতে দাঁড়ালো। এটা দিদানের নিত্যদিনের একটা কাজ। মাঝেমাঝে এই বাড়িটাকে আমার কভি খুশি কভি গমের সেট মনে হয়। এক্সেপ্ট দ্যাট নাচানাচি আর গম্ভীর অমিতাভ বচ্চন পার্ট।
বাইরে এসে দেখলাম বাড়ির সামনের হলুদ আলোগুলো জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। সারিবদ্ধ গাছগুলোর নীচে জ্বলছে সাদা আলো। গাড়িতে উঠতে যেতেই দূর থেকে তোজোকে হেঁটে আসতে দেখলাম। ও গলির মুখে যেন থমকে দাঁড়ালো কিছুক্ষন। তারপর ধীরে ধীরে হেঁটে আসতে লাগল এই দিকে। তোজোকে আমি এইরকম শান্ত দেখেছিলাম যেদিন ওর বাবা একটা বড় ট্রলি হাতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে ট্যাক্সিতে উঠে চলে যায়। তোজো ঠিক সেইদিনও এইরকম ধীর পায়ে হাঁটতে হাঁটতে ট্যাক্সিটার পিছন পিছন গেছিল কিছুটা। উত্তর কলকাতার এই অভিজাত পাড়ার হলুদ আলোয় তোজোর ওই লম্বা চেহারাটা কেমন ক্লান্ত দেখাচ্ছে। মাথা নিচু করে হাঁটছে তোজো। কাছে আসতেই ওর হাতের দিকে চোখ গেল আমার । সাদা ব্যান্ডেজের উপর চাপ চাপ রক্ত ফুটে উঠেছে। ওর মুখের দিকে তাকাতেই দেখলাম ঠোঁটের নিচটা ফুলে নীল হয়ে গেছে। কপালে একটা ব্যান্ডেড লাগানো। আমি কিছু বলতে যেতেই তোজো ক্লান্তভাবে হেসে বলল -"উরিববাস! কি সাজ দিয়েছিস ভাই! তোর ডিলান তো পুরো ফিট খেয়ে যাবে!"
"এইসব কি করে...কোথায়..."--নিজের কানেই বিহ্বল শোনালো নিজেকে।
"ক্যাজ ভাই ক্যাজ! যেখানে যাচ্ছিস যা! এইসব পরে হবে'খন"-- তোজো কোনোমতে কথাগুলো বলে ওর বাড়ির দিকে হাঁটা লাগাল। মন্দিরা আন্টিও বাড়ি নেই। তোজোই বলছিল গতকাল। বুটিকের কাজে শান্তিনিকেতন গেছে। তোজো তাহলে একা একা কি ভাবে....
এইসব ভাবতে ভাবতে গাড়িতে উঠে বসলাম। দাদুন এলে লাল দা গাড়ি স্টার্ট দিল।
এয়ারপোর্ট এরিয়াটা সবসময়েই জমজমাট। দাদুন নেমে একটা ফুলের বোকে কিনল। রায় জেঠুর মেয়ের হলুদ গোলাপ খুব পছন্দের। এয়ারপোর্টে ঢুকে ওয়েটিং এরিয়ার সামনে দাঁড়ালাম। আর দশ মিনিট....চোখ বুজে আমি প্রতি মুহুর্ত গুনতে থাকলাম। নয়....আট... সাত...ছয়...পাঁচ...চার...তিন...দুই....এক ....কই কোনো ঘোষণা হচ্ছে না কেন....বুকের মধ্যে ঢিপ ঢিপ করছে....কোথায় ঋভু দা..... দমবন্ধ লাগছে আমার....বিমানসেবিকা মিষ্টি গলায় বলে উঠল -"the flight from London to Kolkata has arrived.All passengers are requested....." আমার আশেপাশে বহু মানুষ। কিন্তু কারুর কোনো কথা আমার কানে যাচ্ছে না....বিমানসেবিকার সুমিষ্ট কন্ঠস্বর ছাড়িয়েও যেন আমার নিজের হার্টবিট আমি নিজে শুনতে পারছি। এতগুলো মাথার মধ্যে কোথায় ঋভু দা.... ওই তো। ওই তো। ওই যে কালো সোয়েট শার্ট আর রিপড জিন্স । ঋভু দা হাসছে। ঋভু দার চোখগুলো হাসছে। ঋভু দা এগিয়ে আসছে। একটু...আরেকটু...আরেকটু। দাদুন এগিয়ে গেল। ঋভু দা দাদুনকে জড়িয়ে ধরেছে। আমার গাল বেয়ে গরম বাষ্প নামছে। আমি কাঁদছি? আমি কাঁদছি। কেন?? ঋভু দা সত্যিই ফিরেছে। সত্যিই!
"মিতুল! Hey মিতুল! What's up?"--- ঋভু দা'র ডাকে আমার ঘোর কাটল। আমি ঋভু দার মুখের দিকে তাকালাম। কি শান্ত অথচ চঞ্চল মুখ। দুটো চোখে দুটো সমুদ্র। নীল। গভীর। চঞ্চল। আমার নিজের অজান্তেই এক ফোঁটা জল টপ করে ঝরে পড়ল। আমি সবার আড়ালে চোখটা মুছে নিলাম। ঋভু দা লক্ষ্য করলো কি? গাড়িতে দাদুন ফ্রন্ট সিটে বসল । আমি আর ঋভু দা পিছনে। দাদুন আর ঋভু দা কথা বলে গেল অনর্গল। আমি জানলার কাঁচে ঋভু দাকেই দেখে গেলাম। দাদুনকে নামিয়ে যখন গাড়ি বসুরায় বাড়ির গাড়িবারান্দায় ঢুকছে, তখন মালবিকার কল এল। হাতঘড়িতে দেখলাম প্রায় ১০টা। কলটা রিসিভ করতেই মালবিকা থমথমে গলায় বলল -" মিতুল, তুই কোথায়? ব্যস্ত?" আমি না বলতেই মালবিকা বলল- "ত্বরণ তোদের পাড়াতেই থাকে না?" আমি হ্যাঁ বলতেই ও আধ ঘন্টার মধ্যে আসছে জানিয়ে ফোনটা কেটে দিলো। আমায় চুপ করে থাকতে দেখে ঋভু দা বলল- "anything serious?" আমি উত্তর দেওয়ার আগেই রুহি কল করল। কলটা রিসিভ করতেই রুহি চাপা গলায় বলল- "তুই শুনেছিস? তোজো শতানিক দাকে গিয়ে চড়থাপ্পড় মেরেছে।"
আমি চাপা গলায় বললাম -" কি বলছিস? কখন? কিভাবে?"
"শতানিকের জিমের সামনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল। বেরোতেই ক্যালিয়েছে। শতানিক দাও পাল্টা মেরেছে। দিদিভাই ঐখানেই জিম করে তো। ওই বলল।"
"মালবিকা ওই জন্যেই আসছে মনে হয়। কি করি বলতো? তুই আসতে পারবি?"-আমি গাড়ি থেকে নামতে নামতে বললাম। রুহি উত্তরে জানালো ও দশ মিনিটের মধ্যে আসছে।
ঋভু দা বসার ঘরের বড় সোফাটায় বসতেই হরি কা শরবত নিয়ে এল। দিদানকে কাছে ডেকে আমি তোজোর ব্যাপারটা পুরো বলে সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে এলাম। দিদানকে বড্ড খুশি লাগছে এখন। গত কয়েকবছরে এত খুশি দিদানকে দেখিনি। গেটের সামনে দেখলাম রুহি আর মালবিকা দাঁড়িয়ে আছে। তোজোর বাড়ির বেল বাজাতেই তা এসে দরজা খুলল। তা তোজোদের বাড়িতে আছে প্রায় ১০ বছর। মন্দিরা আন্টি না থাকলে তোজোর একমাত্র ভরসা হল তা। তা'কে তোজোর কথা জিজ্ঞেস করতেই ও জানাল তোজো ওর রুমে আছে। আমরা সবাই তোজোর রুমে গিয়ে নক করলাম। ভিতর থেকে তোজো বিরক্তিভরা গলায় বলল- "আমি খাব না তা! প্লিজ যাও।"
আমি আরেকবার নক করে বললাম - "তোজো, আমি মিতুল। একবার খোল।"
তোজো দরজা খুলে ঘরের টেবিল ল্যাম্পটা জ্বালাল। ওকে বড্ড ডিসটার্বড লাগছে। মাথার চুলগুলো উশকো খুশকো। তোজো আমার পিছনে মালবিকার দিকে তাকালো। পিছনে ঘুরে দেখলাম মালবিকা তোজোর দিকে তাকিয়ে আছে। আমি কিছু বলার আগেই ,মালবিকা গটগট করে তোজোর দিকে এগিয়ে গিয়ে ওর গালে ঠাস করে একটা চড় মারল। তারপর চিৎকার করে বলল- "Who gives you the fucking right হ্যাঁ? তুই কে? Stupid! Idiot!"
মালবিকা আবার গটগট করে হেঁটে বেরিয়ে গেল। রুহিকে ইশারা করলাম আমি। রুহি মাথা নেড়ে ওর পিছনে চলে গেল।
তোজো ধীর পায়ে এসে ওর খাটে বসল। আমি ওর বইয়ের টেবিলের তলা থেকে ফার্স্ট এইড কীট বের করে ওর পাশে বসলাম।
তোজোর চোখ থেকে টপটপ করে জল পড়ছে।
"মিতুল, I....I...Love her. Why did she..."
তোজো ওর মাথাটা আমার কাঁধে এলিয়ে দিল।
আমি ওর হাতের ব্যান্ডেজটা খুলে ওষুধ লাগিয়ে দিলাম। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর তোজো একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল- "চ। তোকে এগিয়ে দিই। ১১টা বাজে। "
বাড়ির কাছাকাছি এসে তোজো ইশারা করে বলল- "ওই দেখ তোর ডিলান অপেক্ষা করছে। যা। "
ঋভু দাকে হলুদ আলোয় কেমন মায়াময় লাগছে। আমাদের আসতে দেখে ঋভু দা পায়ে পায়ে এগিয়ে এল। তোজোর সাথে টুকটাক কথা বলে আমরা বাড়ির ভিতরে ঢুকে এলাম। ঋভু দা চুপচাপ হাঁটছে আমার পাশে। আমি কিছু বলব ? না থাক।
"মিতুল!"- ঋভু দা বলল।
"হুম?" -- আমি উত্তর দিলাম।
"তোজো, does he love you?"---ঋভু দার গলাটা থমথমে লাগছে।
"No! why do you think so?" -আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম।
"Then, Do you love him?"-ঋভু দা রাস্তার দিকে তাকিয়ে বলল।
"না!"- ঋভু দা এইসব কি বলছে! আমি তো ওকেই...
ঋভু দা আবার হাসছে। কি শান্ত হাসিটা। ও আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল- "look, it's gonna rain now."
ঋভু দার গলার স্বর ছাপিয়ে ঝপ করে বৃষ্টি নামল। ঋভু দা আমার দিকে তাকাল। আমি ঋভু দার দিকে। আমার জমে থাকা সব অভিমান বৃষ্টিতে ধুঁয়ে যাচ্ছে। ঋভু দা হাসছে। ঠিক সেই আমাদের ছাদের দিনগুলোর মতন। ঋভু দা আর দূরে নেই। আমার কাছেই আছে। আমার কাছে।
And then!? Please ... Badly Waiting for the next part💜🌻
ReplyDeleteSomething big is coming 🌻💜
Delete