শেষ পর্যন্ত তোমাকে চাই 🌻
||৭||
"Aahir, I'm telling you, it's a date!"- একমুখ ভর্তি চিপস চিবোতে চিবোতে বলল রুহি। "date" ....মানে ঋভু দা কি সত্যিই...কাল সন্ধ্যেতে চিলেকোঠার ঘরে বলা ওর ওই কথাগুলো ভাবলেই আমি শরীরের মধ্যে একটা কারেন্ট অনুভব করছি। তোজো একটা সিগ্রেট ধরিয়ে লম্বা ধোঁয়া ছাড়ল। ও এই ব্যাপারে এখনো কিছু বলেনি। তোজোর আর ঋভু দার মধ্যে একটা অদ্ভুত শীতলতা আছে। ওরা দুজন কেউ কাউকে পছন্দ-অপছন্দ কোনোটাই করে না। অথচ এই ব্যাপারটায় তোজোর অপিনিয়নটা দরকার। ফেলুদার পর ওর অবসার্ভেশনে আমি সবথেকে বেশি বিশ্বাস করি। আমি চোখে প্রশ্ন নিয়ে তোজোর দিকে তাকালাম। মালবিকার সাথে ঘটনাটা ঘটার পর ওরা দুজন দুজনকে এড়িয়ে চলে। মালবিকা থাকলে তোজো বসে না। আর তোজো থাকলে মালবিকা চলে যায়। আজ মালবিকার আসতে দেরি হবে জানিয়েছিল। শতানিক দার সাথে দেখা করবে তাই। মালবিকা কাল সেটা জানাতেই কল করেছিল । কিন্তু আরেকটা কি বলতে গিয়েও থেমে গেছিল। বারবার জিগ্যেস করলেও উত্তর পাইনি।
রুহি তোজোর দিকে চিপসের প্যাকেটটা এগিয়ে দিয়ে বলল- "নে। খা। তোকে না দিয়ে খেলে আমার পেট খারাপ হবে। খা!"
তোজো হাসল একটু। তারপর দুটুকরো চিপস মুখে পুরল। ওর হাসিটায় এখন অভিমানের মেঘ জমে আছে। ওর চোখ দুটোর দিকে তাকালাম আমি। তাহলে কাল রাতেও ঘুমায়নি...!
"দ্যাখ মিতুল!"- তোজোর গলার আওয়াজে চমকে উঠে নিজেকে সামলে নিলাম। ভাবলাম আজ বাড়ি ফিরে ওর বাড়িতে যাব একবার।
"দ্যাখ হতেই পারে he asked you out. আবার হতেই পারে he really needs your help কারণ ও কলকাতা ব্যাপারটার সাথে অত সরগর নয়। Either way, don't get your hopes up, okay?"- তোজো কথাটা একেবারে ভুলও বলেনি। তবে আমার এটা শুনতে কেন ভালো লাগল না?
"এই! ক্যানো রে ক্যানো! "- রুহি কাউন্টার করল। "তুই তো এইরকম ডেট ইমাজিন করিস। কলেজ স্ট্রিট, গঙ্গার ঘাট, হাওড়া ব্রিজ ...তাহলে why are you demotivating her? ওই দেখ মালবিকা এসে গেছে। এদিকে!"- রুহি তোজোর সাথে ওর ঝগড়া মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে মালবিকাকে হাত নাড়ল। আমরা ক্যান্টিনের কোনার টেবিলে বসেছিলাম। তোজোকে দেখেই মালবিকা ফিরে যাওয়ার উপক্রম করল।
"দাঁড়া। তুই বস। I am going."- তোজো আমার দিকে কাঁধ ঝাঁকিয়ে ,রুহির কপালে টোকা মেরে ওর ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে নিয়ে হাঁটা লাগল। মালবিকার চোখের পাতা কাঁপছে। ও কি চায় না তোজো চলে যাক? তোজো ক্যান্টিন থেকে বেরোনোর আগেই ফার্স্ট ইয়ারের কিছু মাথা ওকে ছেঁকে ধরল। তার মধ্যে বেশিরভাগই ওর অনুরাগিনী। আমাদের সিনিয়ররা বলে "তোজো হলো রাইকুলে কৃষ্ণ"। তবে কৃষ্ণের সুখ্যাতি অথবা কুখ্যাতি ঠিক যেই কারণে , তোজো তার আশপাশ দিয়ে যায় না। স্কুলেও ও বড্ড পপুলার ছিল। সিনিয়র-জুনিয়র টিচার সবার মধ্যে। স্কুলের স্টুডেন্টস ফোরামে সব স্টুডেন্টরা মিলে তোজোকে "মোস্ট পপুলার স্টুডেন্ট"র ভোট দিয়েছিল। আর ঋভু দা ছিল "মোস্ট হ্যান্ডসাম স্টুডেন্ট"র পোস্টে। তোজো বা ঋভু দার অবশ্য এইসব নিয়ে কিছু যায় আসত না। কিন্তু যত ঝক্কি পোহাতে হত আমার। স্কুলের সময়টুকু তোজো আর আমি একসাথে থাকতাম। ক্যান্টিনে ঋভু দাও আমাদের সাথেই বসত। স্কুল শেষ হলে ঋভু দা আর আমি একসাথে ফিরতাম আর তোজো চলে যেত বাস্কেটবল অথবা ক্যারাটের ক্লাসে।
"আহির! এই আহির!''- রুহি চাপাস্বরে ডেকে মালবিকার দিকে ইশারা করল। মালবিকা মাথা নিচু করে বসে আছে। ওকে এখন ঝিমোনো গোলাপের মতন লাগছিল দেখতে।
"কি হল রে?"- আমি আলতো হাত ছোঁয়ালাম ওর মাথায়।
"আমি আর পারছি না রে! সত্যিই! দমবন্ধ লাগছে আমার! এইভাবে রোজ..."-মালবিকার গলায় কান্না জমা হচ্ছে।
"তাহলে তুই একবার ত্বরণের সাথে কথা বলার চেষ্টা কর!''- রুহি ফিসফিসিয়ে বলল।
"How? I insulted him! তারপরেও why would he talk to me?"- মালবিকার চোখ দিয়ে টপটপ করে জল পড়ছে।
"বলবে। কারণ আমরা বন্ধু আর ও তোকে..."- কথাটা বলতে গিয়েও বলা হলো না। ক্লাস শুরু হওয়ার বেল পড়েছে। পুরো ক্লাসটায় তোজো আমাদের থেকে আলাদা বসল। ক্লাস থেকে বেরোনোর সময়ে ফোনের রবিন পাখি ডেকে উঠল টুইট টুইট করে। ফোন স্ক্রিনে ঋভু দার মেসেজ ভাসছে। ঋভু দা এসে গেছে। আবার একটা বৈদ্যুতিক ঝটকা শরীরের মধ্যে! তোজো আমার কাঁধে হাত রেখে হেসে বলল- "ভয় লাগছে? হয় হয়!" মালবিকা আমাদের থেকে একটু এগিয়ে হাঁটছে। হটাৎ ওর হাঁটার গতি বাড়ল। রুহি আর আমি ওর দিকে ছুটে গেলাম। গেটের সামনে এসে দেখলাম শতানিক দা কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রুহি বিড়বিড় করে বলল- "শয়তান কা নাম লিয়া অর শতানিক হাজির!" "চুপ !" আমি ইশারায় ওকে চুপ করতে বললাম। ঋভু দা কলেজের ঐপারে দাঁড়িয়ে। রাস্তা পার করবে বলে অপেক্ষা করছে। গেট পার হতেই শতানিক দা যেন মালবিকার দিকে তেড়ে এল। চিৎকার করে বলল- "What is the meaning of all this ,huh? What were trying to do?"
মালবিকা শান্ত স্বরে বলল- "চুপ করো। আমার কলেজ এটা। এখানে at least সিন ক্রিয়েট কোরো না। প্লিজ!"
"চুপ করবো? Who the hell are you to tell me that? Where is your hero huh? Wouldn't he come to save his damsel from distress? You ugly wh..."- শতানিকের কথা শেষ হওয়ার আগেই মালবিকা ওর গালে ঠাস করে একটা থাপ্পড় মারল। "you bloody bi...."- শতানিকের কথাটা শেষ হওয়ার আগেই তোজোর লম্বা হাতদুটো শতানিকের জামার কলার খাঁমচে ধরল। শতানিক দা যেন ভূত দেখার মতন চমকে উঠল!
"আর একটা কথা বলবি! মেরে তোর বদনের বিজ্ঞাপন বানিয়ে দেব শালা!"- তোজোকে এতটা রাগতে আমি অনেকদিন পর দেখলাম। ওর চোখদুটো জ্বলছে যেন। মালবিকা পিছন থেকে বলল- "Twaran ,this is my..."
ঋভু দা ইতিমধ্যেই রাস্তা পার করে এদিকে চলে এসেছে। আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে ঋভু দা। আমি একটু এগিয়ে তোজোর কাঁধে হাত রেখে বললাম -"তোজো, ছাড়। কলেজের সামনে...."
তোজো ওর মুঠো করা হাত নামিয়ে আনল আস্তে আস্তে তারপর ঠান্ডা গলায় বলল- "ক্ষমা চা! এক্ষুনি! নইলে ক্যালিয়ে ক্যালেন্ডার করে দেব!"
শতানিক দা কলের পুতুলের মতন মালবিকার সামনে এসে বলল- "I am sorry!" মালবিকা মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিল। শতানিক ওর বাইকে বো বো আওয়াজ তুলে চলে গেলে, তোজো অন্যদিকে হাঁটা শুরু করল। মালবিকা পিছন থেকে বলল -"দাঁড়া!"
"তোজো! শোন মালবিকা কিছু..."- আমি কিছু বলতে যেতেই ঋভু দা আমার হাত ছুঁয়ে বলল- "let them solve ! You come with me!"
তোজো মালবিকার হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে চলে গেল। রুহি একবার ঐদিকে একবার আমার দিকে তাকিয়ে বলল- "তাহলে আমি কি করি? আমি বরং বাড়ি যাই।''
কলেজস্ট্রিট ঘুরে ঘুরে কিছু পুরোনো বই কিনলাম আমি। আর ঋভু দা ওর মেটারিয়ালস। কালকে দাদুর কোম্পানিতে ওর ইন্টারভিউ। সেই নিয়েও যেন একটু চিন্তিত দেখালো ওকে। আমি বরাবর পুরোনো বই কিনি। পুরোনো বইয়ের মধ্যে একটা অদ্ভুত সুন্দর গন্ধ থাকে। নতুন বইয়ের মধ্যে তা কখনোই পাওয়া যায় না। পুরোনো বই খুব তাড়াতাড়ি কাছের হয়ে যায় আমার। কেনা-কাটা শেষ করে কফিহাউসের সামনে এলাম আমরা। ঋভু দা বলল -"চলো একবার ঘুরে যাওয়া যাক।" বংশী দার দোকান থেকে সিগ্রেট কিনে সিঁড়ি বেয়ে উপরে এলাম আমরা।
কফিহাউস আমার খুব প্রিয় জায়গা। পুরোনো বলেই হয়তো। একটা অদ্ভুত শান্তি পাই এখানে এসে। কফিহাউসের যেদিকটায় দুটো বড় জানলা আছে, সেদিকটাকে হাউস অফ লর্ডস বলে শুনেছি। ওইদিকেই জানলার পাশে একটা জায়গা পেলাম আমরা। কফিতে চুমুক দিচ্ছি হটাৎ কানে একটা চেনা গলার আওয়াজ এল। "Oh my god! Is it you ,Writoban?" ঘাড় উঁচু করে দেখলাম পামেলা সেন, আমাদের স্কুলের নামকরা সুন্দরী। বহু মাছই মহাশয়ার ঘাটে খাবি খেয়েছেন। কিন্তু নির্মম হৃদয় উনি বিগলিত চিত্তে ঋভু দাকে প্রেমে ফেলার চেষ্টা করে গেছেন। পামেলা দি ঋভু দাকে জড়িয়ে ধরল তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলল- "Scoot over!" আমি বাধ্য হয়ে সরে বসলাম । জানলা দিয়ে বাইরে আকাশের দিকে তাকালাম। কোথা থেকে কিছু কালো মেঘের দল আকাশজুড়ে বসে রয়েছে। ঋভু দা হেসে হেসে কথা বলেই যাচ্ছে পামেলার সাথে। কই আমার সাথে কথা বলার সময় এত হাসে না তো! আমি কি জেলাস ফিল করছি!! কেন? কেন ঋভু দা জানে না?
"Excuse Me!"- আমি ব্যাগটা হাতে নিয়ে নীচে নেমে এলাম। একাই চলে যাব বাড়ি। নীচে নামতে না নামতেই ঝপ করে বৃষ্টি নামল। ধুর! আমার চোখদুটো জ্বালা করছে বড্ড। কান্না পাচ্ছে! ঋভু দা আর পামেলা দিকে স্কুলে "Ideal couple" বলা হত। এতদিন পর আবার সেই ব্যাপারটা ঘটছে! আমাকেই সরে যেতে হচ্ছে...আমার গাল বেয়ে বাষ্প ঝরছে।
"মিতুল! হাতটা দাও এদিকে।"-ঋভু দার গলার আওয়াজে চমকে উঠলাম আমি। না ওকে বুঝতে দেওয়া যাবে না যে আমি কাঁদছি। কোনোভাবেই না! আমি রুমালটা বের করে মুখ মুছলাম। বৃষ্টির ছাঁটও লেগেছিল মুখে। তারপর ঋভু দার দিকে ঘুরে হেসে বললাম- "কি গো?" ঋভু দা আমার মুখের দিকে তাকালো তারপর ওর হাতদুটো খালি করে আমার হাতে আমসত্ত্ব লজেন্স ঢেলে দিল। ওর মনে আছে? আমার আমার আমসত্ত্ব খেতে ভালো লাগে? আমি মিনিটে সব ভুলে গেলাম। অভিমান? সে তো বৃষ্টির সাথে সাথেই উবে গেছে! শান্তি লাগছে বড্ড!
বাড়ি ফিরতেই হরি-কা আদা চা নিয়ে এল তারপর টেবিলে প্লেটটা নামিয়ে রেখে বলল-"দিদিভাই, রাত্তিরে কি করি বলো তো? "
আমি কিছু বলার আগেই ঋভু দা বলল- "খিচুড়ি করো। প্লিজ হরি-কা। "
কে বলবে এই মানুষটা বিদেশে বড় হয়েছে?
"বেশ তাহলে খিচুড়ি আর ওবেলার ইলিশ মাছ ভাজা আছে।"- রাতের মেনু আওড়াতে আওড়াতে হরি কা চলে গেল। ঋভু দা চা শেষ করে বলল- "মিতুল ! এই মেটারিয়ালসগুলো কাউকে দিয়ে একটু attic'এ পাঠিয়ে দেবে? I really need to freshen up."
আমি মাথা নেড়ে হাসলাম। ঋভু দা চলে গেলে চিনু কাকার সাথে attic'এ গিয়ে ঋভু দার জিনিসগুলো গুছিয়ে রাখলাম। নীচে নেমে নিজের ঘরে আসতেই দেখলাম খাটের উপর একটা ক্যাডবেরি আর জোয়ান বায়েজের একটা সিডি রাখা আছে। তার উপর একটা কাগজে ঋভু দা লিখেছে-"জোয়ান যদি ডিলানের উপর রেগে থাকত, তাহলে কি আমাদের পছন্দের গানগুলো আর গাওয়া হত?"
এই মানুষটার উপর রেগে থাকব আমি? এর উপর রেগে থাকা যায়!
Comments
Post a Comment