Down The Memory Lane

                       ||৩||
       কেনাকাটা সেরে শপিং মল থেকে বেরোতেই একটা গরম হলকা এসে ছুঁচের মতন বিঁধল শরীরে। গাড়িতে উঠেই দিদান তাড়াতাড়ি বলল -"এই লাল! এ.সি'টা চালা। এই গরমে এতক্ষণ বসে আছিস কি করে?উফফ!" গাড়ির ভিতরের তাপমাত্রা একটু ঠান্ডা হলে  একটা লম্বা নি:শ্বাস নিয়ে  দিদান বললো- "লাল! একটু গান চালা তো। এই আবহাওয়া দপ্তরটা কোনো কাজের না সত্যিই! বলে নাকি বৃষ্টি হবে! এদিকে গোটা কলকাতা সেদ্ধ হয়ে গেল প্রায়! "
আমি দিদানকে দেখছিলাম মন দিয়ে। দিদানের ফর্সা কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। গাড়ির ভিতরে এই মায়াময় হলুদ আলোয় দিদানকে বড্ড নিজের লাগছে। চোখে মুখে উচ্ছাস নিয়ে দিদান মিউজিক প্লেয়ারের সুরে সুর মিলিয়ে গাইছে- "পুরানো সেই দিনের কথা" ....

মা চলে যাওয়ার পর বাবা কেমন যেন একটা হয়ে গেছিল। আমার সাথে কথা বলত না ঠিক করে। দাদুনকে নিয়ে অফিস যেত ।সারাদিন অফিসেই থাকত। রাত্রে বাবা যখন ফিরত, আমি তখন মায়ের ছবি জড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছি। একদিন হঠাৎ বাবা এসে বলল আমরা নাকি এখন থেকে সাহেবের বাড়ি থাকব। যেদিন আমি প্রথম বসুরায় বাড়ি আসি,হাঁ করে দেখছিলাম চারদিক। এত বড় বাড়ি হয়! দুর্গা ঠাকুর তৈরি হচ্ছে! কি সুন্দর দাবার ছকের মতন মেঝে! কিন্তু আসল দুর্গা ঠাকুর কই? বাবা যে বলেছিল এই বাড়িতে একটা দুর্গা ঠাকুর থাকে...আসল দুর্গার আবির্ভাব হল আর কিছুক্ষণের মধ্যেই। হাতে এক থালা পেস্ট্রি নিয়ে। দিদান আমাকে কাছে টেনে নিতেই আমি মায়ের গায়ের গন্ধ পেয়েছিলাম। সেইদিন থেকে বাবা সারাদিন অফিস থাকলেও আমি স্কুল সেরে এসে  ঘরে ব্যাগটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়েই চলে আসতাম আমার দুর্গা  ঠাকুরের কাছে। এক থালা খাবার সাজিয়ে দিদান বসে থাকত আমার জন্যে। আমার খাওয়া শেষ হতে না হতেই হরি-কা এক প্লেট ফল নিয়ে আসত। তারপর চলত আমার পিয়ানো সেশন। 
"মিতুল ! এই মিতুল! আজ রাতে চাইনিজ খাওয়া যাক। কি বলিস?" 
"হ্যাঁ ?"-দিদানের হাতের ছোঁয়ায় আমি হালকা চমকে উঠলাম । 
"চাইনিজ না ফ্রেঞ্চ কোনটা?"-দিদান আবার জিগ্যেস করল।
"চাইনিজ।দাদুন তো ফ্রেঞ্চ অত ভালোবাসে না।''- আমি বাইরের দিকে তাকালাম। দিদান আমার চোখের জল এখনো লক্ষ্য করেনি। দেখলেই বকা খাবো।

"হরি দা! হরি দা"- দিদান নিজের শরীরটা বড় সোফায় এলিয়ে দিয়ে ক্লান্ত স্বরে ডাকল। 
হরি-কা দু-গ্লাস আমপোড়া শরবত নিয়ে হাজির হল। এই শরবতটা হরি-কা দারুন বানায়। তোজোর মতে এটা নাকি পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য। 
"এই খাবারগুলো নিয়ে যাও না। খাওয়ার আগে একটু গরম করে নিলেই হবে।"-হরি-কাকে আমি খাবারের প্যাকেটগুলো দেখিয়ে বললাম। 
এক চুমুকে প্রায় অর্ধেক গ্লাস শরবত শেষ করে দিদান বলল- "মহারাজ ফিরেছেন?" 

হরি কা হেসে ঘাড় নাড়িয়ে বলল- "হ্যাঁ। বাবু স্টাডিতে । বই পড়ছেন।"
"ও হ্যাঁ। ওনার তো এখন বই পড়ার সময়। ঠিক আছে চলো আমরা ঋভুর ঘরটা গুছিয়ে ফেলি বরং।"- দিদান ঘড়ির দিকে এক ঝলক তাকিয়ে নিয়ে বলল।

"তুমি বস। আমি গুছিয়ে দেব ঘর। তুমি শুধু একবার দেখে নিও। কেমন?" - আমি উঠে দাঁড়িয়ে আলগোছে খোঁপা করতে করতে বললাম। 
"তুই গোছালে আমার চোখ বুলাতে হবে না। হরি দা,তুমি আমায় আরেক গ্লাস শরবত দাও তো। আর টিভিটা চালিয়ে দাও না একটু। ওগো বধূ সুন্দরীটা শুরু হয়ে গেছে মনে হয়।"-দিদান আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে বলল।

ঋভু দার ঘরটার একটা অদ্ভুত আকর্ষণী ক্ষমতা আছে। গত ছয় বছরে ঋভু দা এই ঘর ব্যবহার করেনি। অথচ এই ঘরটাতে ঢুকলেই মনে হয় ঋভু দা এই ঘর ছেড়ে গেছে। কিন্তু এই ঘরটা ওকে ছাড়েনি! এই ঘরটার একটা দেয়ালে শুধু পোস্টার লাগানো। সত্যজিৎ থেকে হিচকক,  কার্ট কোবেন থেকে অসবোর্ন সবার ছবিই আছে ওখানে। কিন্তু ঘরে ঢুকেই সবার আগে চোখ পড়ে ডিলান আর জোয়ানের ছবিটার উপর।  
"মিতুল, Look this is Ozzy Osbourne.One of the greatest musician in the history. And that is kurt Cobain.That is Janis Joplin. মনে আছে, একদিন তোমায় ওর একটা গান শুনিয়েছিলাম?"- ঋভু দা'র গলার স্বরের উচ্ছাস ছাপিয়ে ওর ওই গভীর নীল চোখদুটো কথা বলত যেন। ওর মায়ের চোখদুটোও ঠিক এরকম ছিল। ঋভু দা'র মা আইরিন ছিলেন আইরিশ। অনির্বাণ কাকু যখন অক্সফোর্ডে পড়াশোনা করতে যান তখনই আইরিনের সাথে আলাপ হয় তার। আলাপ থেকে প্রেম এবং তারপর বিয়ে। আইরিনকে আমি একবারই দেখেছিলাম। ছিপছিপে লম্বা আইরিন যখন ভাঙা ভাঙা বাংলায় আমার নাম ধরে ডাকতো, আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতাম ওঁর চোখের দিকে। সেইবার দেখা হলেও ঋভু দা'র সাথে আমি কথা বলিনি। 

কিন্তু এর ঠিক এক বছরের মাথায় একটা গাড়ি দুর্ঘটনায় আইরিন মারা যায়। অনির্বাণ কাকু যেদিন ঋভু দা'র হাত ধরে বাড়ি ফেরে, ওঁকে দেখে আমার বাবার মুখটা মনে পড়ছিল। মা যেদিন মারা যায় বাবাও সেদিন ঠিক এরকম ভাবেই শক্ত করে আমার হাতটা ধরেছিল...আর ঋভু দা? ওর মুখের দিকে আমি তাকাতে পারিনি। প্রায় তিনবছর ঋভু দা এখানে ছিল। অনির্বাণ কাকুকে রিসার্চের কাজে চলে যেতে হয়েছিল জাপানে। সারাদিন ঋভু দা নিজের ঘরে থাকত। বই পড়ত, নয় গান শুনত। আমি দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব লক্ষ্য করতাম। আমার বয়স তখন তেরো  আর ওর পনেরো। ঋভু দা আমার দিকে এক ঝলক তাকিয়েও চোখ ঘুরিয়ে নিত। খুব অল্প কথা বলত। এইভাবে প্রায় এক বছর কেটে গেল। আমাদের স্কুলেই ক্লাস টেনে ঋভু দা'কে ভর্তি করে দিল দাদুন।একসাথে স্কুলে যাওয়া-আসায় আমাদের কথাবার্তা শুরু হল। তবে তার সিংহ ভাগ কৃতিত্বই ডিলান আর বায়েজের। 

"মিতুল দিদি! "- হরি-কা আমার পাশে এসে দাঁড়াল। "একবার দেখে নাও না আলমারিটা। ঠিক আছে?"

আমি হেসে মাথা নাড়িয়ে বললাম- "হ্যাঁ ঠিক আছে। তুমি যাও। বাকিটা আমি করে নেব!"

ফোনের রবিন পাখি আবার টুইট টুইট করে ডেকে উঠল। স্ক্রিন অন করতেই ঋভু দা'র নামটা জ্বল জ্বল করে উঠল।
"Mitul, do you need something ? I am out to buy some gifts for dadun and didan."
"No. I don't need anything. Just come back already."
রিপ্লাইটা পাঠাতে গিয়ে মনে হল শেষের কথাগুলো কেমন শোনাচ্ছে। অতএব ব্যাকস্পেস। 
ঋভু দা'র আবার একটা মেসেজ 
"What should I buy for my old lady? She likes perfume, right?"

"Yes.She does. But go for something sweet . And dadun loves ties, by the way. "

"And you?"

"I don't want anything. Just be safe on your way back. Okay?"

"দিদিভাই! দিদিভাই! খাবার বেড়েছি। আয়!"-দিদান নিচ থেকে ডাক দিল।

ঋভু দা'র ঘরের বিশাল বেলজিয়ান কাঁচের আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম আমি। ঋভু দা'কে বোঝাই কি করে যে ওর থেকে বড় উপহার আমার কাছে আর কিছু নেই!





Comments

  1. Just can't wait for the next episode.. Darun hocche.. ❤️

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular Posts