''প্রথম কালবৈশাখী"

                         ||১||

গিন্নি!" "ও গিন্নি!"- দাদুনের চিৎকারে প্রায় পড়ে যাওয়ার জোগাড় হল আমার। আমি টুলের উপর দাঁড়িয়ে দিদানের পোষা টিয়াকে লঙ্কা খাওয়াচ্ছিলাম। আমি খুব একটা বেঁটে নয়। তবে উত্তর কলকাতার এই বিশাল বনেদি বাড়িগুলোর ছাদ একটু বেশি উঁচু। দাদুনকে নকল করে, 'তিন্নি', আমাদের পোষা টিয়াও বলে উঠল-"গিন্নি!".."গিন্নি!" আমি কোনোমতে নিজেকে সামলে নিয়ে হেসে বললাম- "তবে রে! ভ্যাঙানো হচ্ছে? গিন্নি জানতে পারলে কিন্তু..." আমার মনে হল, কথাটা শুনে তিন্নি যেন ঠোঁট বেঁকিয়ে মুচকি হাসল। দিদানের কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে দাদুন আরো জোরে "দিদিভাই!" "মিতুল!" "আহি!" ইত্যাদি যতগুলো নামে আমায় মানুষ চিনে থাকে ,ডাকতে লাগল। খেয়েছে! এইবার আমায় নিয়ে পড়েছে! চিৎকারের ফ্রিকোয়েন্সি বর্ধিত হওয়ার আগে আমায় অগত্যা দৌড় লাগাতে হল বড় বারান্দার দিকে। ততক্ষনে দিদান নেমে এসেছে ছাদ থেকে ফুল নিয়ে। প্রতিদিন সকাল হতে না হতেই দিদানের ছাদে যাওয়া চাই। ঘন্টা দেড়েক ধরে গাছেদের গান শুনিয়ে ঘুম থেকে তোলা চাই। তারপর ঠাকুরপুজোর জন্যে ফুল তুলে আনা চাই। তারপর চলে দিদানের গোপালসেবা। তাও ঘন্টা খানেক। ছাদ থেকে হুড়মুড়িয়ে নেমে আসার জন্য দিদানের চোখমুখ হালকা লাল। হাঁফাতে হাঁফাতে এসে চেয়ারে ধপ করে বসে পড়ল। একটু নিশ্বাস নিয়ে ব্যাজার মুখে বলল-"সাতসকালে গিন্নি গিন্নি করে বাড়ি মাথায় করছে...হয়েছেটা কি? হ্যাঁ?"
"তা গিন্নি গিন্নি না করে অন্য মহিলার নাম নেব নাকি? তুমি বড্ড বেরসিক! সেই স্কুল জীবন থেকেই...." দাদুনের ঘনস্বরে দিদানের মুখে হালকা লজ্জার আভা খেলে গেল যেন।গ্র্যান্ডফাদার ক্লকের পাশের থামটাতে হেলান দিয়ে আমি তাকিয়েছিলাম ওদের দিকে। মাথার উপরে কাঁচের ঝাড়লণ্ঠনে রোদ ঠিকরে দিদানের সাদাকালো চুলে পড়ছিল। আমার বেশ ভাল লাগছিল ওদের দেখতে। মনে হচ্ছিল এই উত্তুরে কলকাতার বনেদি বাড়ি, বাইরে মুখ ভ্যাঙচে বসে থাকা আকাশ, নিচের গাড়িবারান্দায় লালদার চিৎকার,গাড়ির উপর জলের ঝপঝপ শব্দ পেরিয়ে আমি চলে গেছি কোনো দূর উপদ্বীপে। যেখানে সমুদ্রের  ধারে ,উবু পাথরের উপর বসে দাদুন আর দিদান অনর্গল হাসছে! আমি নিজের ঘর থেকে একদৌড়ে ক্যামেরাটা নিয়ে এলাম। উচ্চমাধ্যমিক পাশ করার গিফট এটা। দাদুন দিয়েছিল। এইচ.এসের রেজাল্ট যেদিন বেরোয়, সেইদিন এই সাদা চুলের কিশোর-কিশোরীর কি আনন্দ! দিদান বাড়ির সব কাজের লোকের বাড়িতে মিষ্টি পাঠিয়েছিল আর দাদুন অফিস ফেরত এই ক্যামেরাটা কিনে এনে দিয়ে বলেছিল- "এখন থেকে এতে আমাদের ছবি তুলিস। কেমন?"সেই থেকে চলছে। দাদুন আর দিদানের মোনোক্রম সিরিজ বানিয়ে ফেলেছি একটা। ক্যামেরার খুট শব্দে দিদান চমকে দাদুনের হাতটা ঠেলে সরিয়ে দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল-"দিদিভাই! ফুলগুলো ঠাকুরঘরে রেখে দিয়ে আয় তো।" এরপর দাদুর দিকে ফিরে কপট রাগে বললো- 'এই বুড়ো! সাতসকালে ভীমরতি হচ্ছে? অফিস যাওয়া নেই?"

"দিদিভাই তুই বস তো! এখন কোথাও যাবি না। "-দাদুন আমার হাত থেকে ফুলের সাজি নিয়ে টেবিলে রেখে দিয়ে ,দিদানের দিকে তাকিয়ে বলল-"অফিস গেলেই তো বাঁচো! কোথায় একটু ভালোভাবে কথা বলবে তা নয়..."

দাদুন-দিদানের প্রতিদিনের এই খুনসুটি মাঝখানে হরি-কা এসে, দাদুনের সামনে এক গ্লাস বাদাম শরবত রেখে গেল। হরি-কা নাকি গত চল্লিশ বছর ধরে এই একই সময়ে দাদুনকে শরবত দেয়। দাদুন মজা করে বলে- "ওই বুড়ো ঘড়ি ভুল হতে পারে। কিন্তু হরি..নো নেভার!" হরি-কা এই বসুরায় বাড়ির সবচেয়ে পুরোনো লোক। দাদুন-দিদানের প্রেমজীবন থেকে অনির্বাণ কাকু মানে দাদুন-দিদানের একমাত্র ছেলের প্রেমজীবন সবই দেখেছে হরি-কা। মাঝে মাঝে কিছু রংহীন সন্ধ্যেতে হরি-কা যখন সেই গল্পের পেটি খুলে বসে,তখন ওকে লায়ন কিঙের সেই বুড়ো রাফিকির মতন দেখায়।  বারান্দার ঝাড় বাতির হলুদ আলো পেরিয়ে আমাদের রাফিকি হরি-কা ফিরে যায় অতীতে। 

"এই যে সক্কাল সক্কাল কাক ওড়ানো চিৎকারটা করলে সেটা কিসের জন্য?"- দিদান নিজের ভিজে এলো খোঁপাটা খুলতে খুলতে বলল। প্রতিদিন সকালে দিদানের গা থেকে একটা মিষ্টি গন্ধ আসে। গন্ধটা অদ্ভুত রকমের মিষ্টি! স্নিগ্ধতা আর প্রাচীনত্ব মিশে থাকে ওতে। আমাদের বাড়িতে যে দূর্গা ঠাকুর তৈরি হয়, তার চুল যদি সাদা করে দেওয়া হয় খানিক ,তবে আমার দিদানের মতন দেখতে লাগবে। আমি দিদানের কাঁধে মাথা এলিয়ে দিলাম। বাঁ হাত দিয়ে আমার গালে হালকা চাপড় মারতে মারতে দিদান মৃদুস্বরে জিগ্যেস করলো-"আজ ইউনিভার্সিটি নেই রে দিদিভাই?"

"আছে। ক্লাস দেরিতে। "-আমি চোখ না খুলেই বললাম। 
"উফ! আমাকে কথাটা বলতেই দিচ্ছে না তো!"- দাদুন এক চুমুকে বাদাম শরবত শেষ করে ঠকাস করে টেবিলে রাখল । 
"উঃ ! নাটক! বলো কথা! কে বারণ করেছে..."- দিদানের কথা শেষ না করতে দিয়েই দাদুন বলে উঠল- "ঋভু ফিরছে পরশু! স্কাইপ করেছিল কিছুক্ষণ আগে!"---দাদুনের উত্তেজিত কন্ঠস্বর আমার কানে এসে পৌঁছাচ্ছিল না আর। শুধু একটা শব্দ আমার মনের মধ্যে প্রবল ঝড় তুলল। প্রথম কালবৈশাখীর ঝড়!  ঋভু দা! ঋভু দা ফিরছে! ইয়ে জবানি হে দিবানির শেষ দৃশ্যে নেয়নার চোখে জল কেন ছিল আমি বুঝতে পারছি। এখন এইমুহূর্তে আমাকে যদি পৃথিবীর সবচেয়ে তেঁতো ওষুধটাও কেউ খেতে দেয়, আমি হাসতে হাসতে খেয়ে নেব। আমার চোখদুটো এখনো বোজা। অথচ আমি তো স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি চৈত্রের সেই বাদামি বিকেলটা। আমার চোখের সামনে থেকে সরে যাচ্ছে এই গোটা শহর....লালদার চিৎকার কমে আসছে ধীরে ধীরে। আমি শুধু দেখতে পাচ্ছি একটা এলোমেলো হাওয়ার বিকেলে টেরাকোটারঙা পাঁচিলে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ঋভু দা স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আর খানিকক্ষণ পর আমাদের পরিচিতি হওয়ার পর  পঞ্চাশতম দিনে প্রথম কথা বলছে। গম্ভীর গলায় জিগ্যেস করছে- "জোয়ান বায়েজ? ওয়্যার ইউ সিংগিং জোয়ান বায়েজ?"

Comments

  1. Excellent writing....Keep going

    ReplyDelete
  2. ❤️ হাই আপু , আমি উষা ।
    It is very good what you have written, I love it !
    🌸

    ReplyDelete
  3. I liked it and specially the way west bengali use shuddho Bangla, liked it

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular Posts