"At favourite with Favourites"

                          ||২||
"দিদানকে নিয়ে ৫.৩০টার মধ্যে চলে এস। কেমন?"--লাল দাকে একটা টুকরো নির্দেশ ছুড়ে দিয়ে আমি ভারতের সবচেয়ে পুরোনো কলেজের ভিতরে পা বাড়ালাম। মার্চ মাস চলছে। আজ আবার  নাকি বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে। জুন থেকে নতুন সেশন শুরু। কলেজের দেয়ালগুলোয় তাই চলছে গ্রাফিটির উপর হোয়াইট ওয়াশ । 
"যতই চুন মারুক, নিজের দুর্নীতিগুলো ঢাকতে পারবে এই খচ্চর কর্তৃপক্ষ!"- ঘাড় ঘোরাতেই দেখলাম তোজো এসে দাঁড়িয়েছে আমার পাশে। ছোটবেলা থেকে একসাথে বড় হয়ে ওঠা আমাদের। এক পাড়া, এক স্কুল আর এখন একই কলেজ। আমাদের পছন্দগুলোও প্রায় সব মিলে যায়। আমাদের দুজনকে পাড়ায় ''মানিকজোড়" বলে ডাকে সবাই। কিন্তু কলেজে ঢোকা ইস্তক তোজো নিজেকে সক্রিয় রাজনৈতিক কাজকর্মের সাথে জড়িয়ে ফেলেছে। ওর চোখগুলো জ্বলজ্বল  করে ''বিপ্লব''এর কথায়। ওর মায়ের কাছে অগত্যা আমাকে এই ব্যাপারটা চেপে যেতে হয়। 
"এইভাবে সত্যি চাপা যায় ভেবেছ, ভীরু..."-তোজোর কথায় আমার চমক ভাঙতেই দেখলাম তোজো পায়ে পায়ে দেয়ালটার দিকে এগোচ্ছে। এই দেয়ালের গ্রাফিটিটা তোজোর নিজের করা। আমি পিছন থেকে ওর ছাই রঙের পাঞ্জাবিটা খাঁমচে ধরলাম। তোজোর চোয়াল শক্ত হচ্ছে। ফর্সা লম্বা আঙুলগুলো তির তির করে কাঁপছে! আবার একটা ঝামেলা পাকাবে ছেলেটা। আমি ওর পাঞ্জাবির আস্তিনে আবার টান মেরে বললাম- "চ এখান থেকে। মালবিকারা অপেক্ষা করছে। চ!"

তোজোর মুখ আমি কখনো গোমড়া দেখিনি। ও সারাদিন খুশি থাকে। আর অন্যকে খুশি করার একটা অদ্ভুত ক্ষমতা আছে ওর। সারাদিন আমার ,মালবিকার আর রুহির পিছনে লেগে, ভিসিকে গাল দিয়ে আর 8.5 CGPA নিয়ে পাশ করে ওর দিন কেটে যায়। বি.সি.জি প্রথম ক্লাসে ওকে যখন জিগ্যেস করেছিলেন- ''why did you choose History?" তোজো সটান উঠে দাঁড়িয়ে বলেছিল- "to find out the truth!"

সেইদিন থেকে বি.সি.জি ত্বরণজিৎ বলতে অন্ধ!

গোলগাল,ফর্সা মালবিকা তোজোর এহেন শান্তিপূর্ণ জীবনে ঝড় তুলেছে। তোজোর মালবিকাকে প্রথমদিন "কিউট" মনে হয়েছিল। গত এক বছরে সেটা সুপারলেটিভ ডিগ্রিতে পরিণত হয়েছে। কিন্তু তোজোর এই "প্রেম করব প্রেম করব" জীবনে একটা বাঁধা হল শতানিক দা। মালবিকার মাসকুলার বয়ফ্রেন্ড। তোজো শুধু মাঝে মাঝে একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ছেড়ে বলে- " দেখে দেখেই নিজের ব্যাটারি খরচ হয়ে যাবে। শালা একেই বলে আনরিকুইটেড লাভ! মিতুল তোর ডিলান এইবার ফিরলে..." --আমি চোখ বড় বড় করতেই চুপ করে যায়। কলেজের মেয়েদের মধ্যে তোজোর জনপ্রিয়তা প্রচুর। জুনিয়র থেকে সিনিয়র সবাই ত্বরণ দা বলতে অজ্ঞান! কিন্তু তোজোর তো চোখ শুধু "কিউটেস্ট" এর দিকে। 
আমরা ক্লাসে ঢুকতেই রুহি হাত নেড়ে চিৎকার করতে লাগল। তোজো ব্যাগটা ছুঁড়ে টেবিলে রেখে রুহির কপালে একটা টোকা মেরে বলল- ''এই চিংড়ি , লাফাচ্ছিস কেন এইভাবে?" 
রুহি ওকে মুখ ভেঙিয়ে আমার দিকে ঘুরে বলল- " আহির, Bighit has uploaded a new BTS Mv।  তুই দেখেছিস? "
আমি হ্যাঁ না বলার আগেই রুহি ইউটিউব খুলে চালাল গানটা। রুহি মালবিকাকে খোঁচা মেরে বলল " এই এই ! এতে V এর থেকে Jungkookকে বেশি কিউট লেগেছে কিন্তু!" 
অন্যদিন হলে মালবিকা এখন এটা নিয়ে রুহির সাথে ছোটখাটো মক পার্লামেন্ট বসিয়ে দিত। কিন্তু আজ একটু ম্লান হেসে টেবিলে মাথা নিচু করল। আমি রুহিকে ইশারায় জিগ্যেস করলাম ও কিছু জানে কি না। ও দুদিকে মাথা নাড়াল। অতএব এইবার আমার ব্যোমকেশ হওয়ার পালা। মালবিকার রুবি পড়া ফরসা আঙ্গুলটা কাঁপছে। আমি আলতো করে ওর হাতের উপর হাত রেখে নরম স্বরে জিগ্যেস করলাম- " কি হয়েছে রে?" ও মাথা তুলতেই দেখলাম ওর চোখের কোণে জল চিকচিক করছে। নিঃশব্দে ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করে টেবিলে রাখল ও। আমরা তিনজন উঁকি মারতে দেখলাম শতানিক দা লিখেছে- "you are so backdated and old school. You think you are cute? Give me a break ! You look like a potato!"
তোজো মেসেজগুলো পড়ে ধীরে ধীরে নিজের লম্বা শরীর এলিয়ে দিল পিছন দিকে। ওর চোয়াল শক্ত হচ্ছে আবার। রুহি মালবিকার কাঁধে হাত রেখে বলল- "নামটাই তো শতানিক। কাজকর্ম তো SATANIC হবেই। Dummy শালা!"

তোজো ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল- "চারটে বাজে প্রায়। আজ আর ক্লাস হবে না। চ একটু ফেবারিট যাই। আমার ট্রিট। চ!"
মালবিকাকে এক প্রকার টেনেই নিয়ে আসা হল ফেভারিটে।
সেই স্বাধীনতার সমকালীন এই ফেবারিট কেবিন। "কত গভীর রাতে এই জায়গাটা বিপ্লবীদের hideout হয়ে উঠেছে। জানিস?"- তোজো পানকেকে একটা কামড় বসিয়ে বলল। 
"মাস্টারদা এখানে মিটিং করতেন। যেই টেবিলটায় আমরা বসে আছি , এখানে বসে কত বিখ্যাত মানুষ চা খেয়ে গেছেন। সুনীল-শক্তির জুটি এখানে বসে কত কবিতা লিখেছে।" -তোজো এক কামড়ে বাকি পানকেকটা শেষ করে একটা সিগ্রেট ধরালো। মালবিকা ওর কথা শুনছিল মন দিয়ে। ওর দু আঙুলের ফাঁকে ধরা সিগ্রেটটায় পুরু ছাই জমেছে। কিন্তু ওই দৃষ্টিতে কি শুধুই জানবার ইচ্ছে ? তোজো ওর দিকে তাকাতেই সঙ্গে সঙ্গে চোখ সরিয়ে নিল মালবিকা। ফোনটা বেজে উঠতেই ভাবনায় খেদ পড়ল আমার। 
"মিতুল কলেজের গেটে দাঁড়িয়ে আছি। আয়।" - দিদান তাড়াতাড়ি বললো। 
আমি ঘড়ির দিকে তাকালাম। সবে পাঁচটা। সকাল থেকে দশবার ঋভু দা'র ঘর গোছানো হয়েছে। আজ মনে হয় গোপালকেও কিছুটা স্যাক্রিফাইস করতে হয়েছে ! ঘরের পর্দা থেকে বিছানা বালিশ বদলেছে কম করেও দশ-বারো বার। এইবার জামাকাপড়....আমি হেসে ফোনটা কেটে ব্যাগে ঢোকাতেই রুহি তা লক্ষ্য করে বলে উঠল- "এই...এই আহির ! তুই হাসলি যে? কি হয়েছে বল?"
তোজো ওর মাথায় চাঁটি মেরে প্লুটোর মতন মুখ করে বলল- "বুঝতে পারলি না চিংড়ি? Her dylan is coming back!" 
"Her Dylan" শুনতেই কি ভালো লাগে! একটা ডাকনামের ছোঁয়ার মতন মিষ্টি লাগে। আমি আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ালাম। ওদের সবার দৃষ্টি আমার দিকে। আমি হেসে বললাম - "উফফ! হ্যাঁ! দিদানের সাথে ঋভু দা'র জন্যে শপিংয়ে যাচ্ছি। টাটা!" 
প্রায় একদৌড়েই বেরিয়ে এলাম ফেবারিট থেকে। 

Comments

Popular Posts