"It's a beautiful life!" 🌼🌼

                      || ৮ ||

"There will be a surprise test next week. Be prepared guys."- বি. সি.জি স্যার ওনার ব্যারিটোন আওয়াজে ক্লাস শেষ হওয়ার ঠিক পাচঁ মিনিট আগে বোমাবর্ষণ করলেন। বি.সি.জি'র সারপ্রাইজ টেস্ট মানে সেখানে চীন থেকে স্বদেশী আন্দোলন কোনোটাই বাদ যাবে না। আজ আর আড্ডা দেওয়ার প্রশ্নই উঠল না। বাড়ি ফিরেই ঠিক করলাম পড়তে বসে যাব। ইতিহাসকে ভালোবাসতে শিখিয়েছেন বি.সি.জি। ওই মানুষটার নেওয়া  সমস্ত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারলেই না আমার ভালোবাসা সফল। 

বাড়ি ফিরতে ফিরতে প্রায় ৬টা বাজল। পরিতোষ দাকে কয়েকটা বইয়ের কথা বলেছিলাম। সেগুলো নিয়ে ফিরলাম একেবারে। বাড়ি ফিরে ঘরে ব্যাগ রেখে বারান্দায় এলাম। দাদুন আজ তাড়াতাড়ি অফিস থেকে ফিরেছে। তাহলে কি ঋভু দাও ফিরেছে....

তিন সপ্তাহ হলো ঋভু দা দাদুনের কোম্পানিতে জয়েন করেছে ইন্টার্ন হিসেবে। দাদুন রোজ এসে দিদানকে সারাদিনের গল্প শোনায়। অফিসে কি হলো...ঋভু দা কত সুন্দর একটা প্রেজেন্টেশন করল...ইত্যাদি ইত্যাদি। দিদান সেইসব শুনে কখনো খুশি হয়। কখনো দাদুনের উপর চোটপাট চালায়। আজ অবশ্য দুজনের মধ্যে চতুর্থ পানিপথের যুদ্ধ লাগবে লাগবে মনে হল। আমি একটা চেয়ার টেনে বসতেই দিদান একটা কাপে চা ঢেলে দিল। 

দাদুন চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলল- "দেখো গিন্নি, কাজটা তো ওকে শিখতে হবে নাকি? এক্সপেরিয়েন্স তৈরি করতে গেলে প্রেসার তো নিতেই হবে।" 

দিদান অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে চায়ে চুমুক দিল। দিদানের এই মূর্তি দাদুন ভয় পায়। দিদান এখন অফেন্সিভ মোডে রয়েছে এবং সেটা মৌনতা অবলম্বন। এই সাইলেন্ট ট্রিটমেন্টটা এই বাড়ির গাছেরাও ভয় পায় মনে হয়। 

"গিন্নি!"- দাদুন একবার দিদানের দিকে আরেকবার আমার দিকে তাকাল। শেষমেশ "তুই কিছু কর দিদিভাই" মার্কা লুক নিয়ে দাদুনের চোখদুটো আমার উপর এসে ফিক্সড হলো। অগত্যা এইবার আমার জোয়ান বায়েজ থেকে জোয়ান অফ আর্ক হওয়ার পালা...

আমি দিদানের হাতের উপর হাত রেখে বললাম- "দিদান...তুমি নিজেও জানো দাদুন যা করছে ঋভু দার ভালোর জন্যেই। আর তোমার কথাতেই ইন্টার্ন থেকে শুরু করার কথা ঠিক হয়েছিল ,তাই না? তুমি তো বলতে, পিয়ানোর রিডস চিনতে না শিখলে পিয়ানো বাজানো যায় না?"

দিদান আমার দিকে তাকিয়ে হাসল তারপর বলল- "তুই এত বড় কবে হয়ে গেলি রে দিদিভাই?" দেখলাম দিদানের চোখের কোণে জল চিকচিক করছে। আমি দিদানকে জড়িয়ে ধরে বললাম-"তাহলে সন্ধি হয়ে গেল তো? এরপর আর ঝগড়া কোরো না প্লিজ।"

দাদুন দিদানের সাথে কথা বলতে বলতে ঘড়ির দিকে চোখ গেল আমার। বারান্দায় একটা বড় গ্র্যান্ড ফাদার ক্লক আছে। সেটায় ঢং করে ৭টা বাজল। ইশশ! অনেক পড়া বাকি। দাদুন-দিদানকে বলে নিজের ঘরে চলে এলাম। ফ্রেশ হয়ে পড়তে বসলাম। রায়া পিসি এসে এক কাপ কফি রেখে বলল-"তুমি কি আজ রাতে পড়বে? তাহলে আমি না হয়..."

"না বাবা। তুমি জেগে থেকো না। আমি কফি করে নেব'খন"-আমি রায়া পিসিকে আশ্বাস দিলাম। এই মানুষটা রাত জেগে বসে থাকবে তারপর সকাল থেকে একনাগাড়ে কাজ করবে। 

"ওইদিকে তো ঋভু দাদাভাই চিলেকোঠার ঘরে গিয়ে যে কাজে বসেছে ,এখনো বেরোয়নি।"- রায়া পিসি একমনে কথা বলতে বলতে চলে গেল। রাত ১০টায় খেতে এলাম নীচে। ঋভু দা আসেনি। দিদান মুখ হাড়ি করে বলল- "রায়া দি, ঋভুর খাবারটা তুমি উপরে দিয়ে এস। এই বুড়োটা ওকে এত কাজ দিয়েছে যে ছেলেটা খেতেও আসতে পারছে না নীচে। যতসব!" দাদুন মুখ কাঁচুমাচু করে চুপচাপ খেয়ে নিল। 

 রাতের খাওয়া শেষ হলে আমি ঘরে ফিরে পড়তে বসলাম। আজ দুপুরবেলায় বড্ড গুমোট লাগছিল। সন্ধ্যে থেকে একটানা কিছুক্ষণ বৃষ্টিও হয়েছে। জানলার সামনে এসে দাঁড়াতেই একটা ভেজা হাওয়া ছুঁয়ে গেল। বারান্দার ঘড়িতে ঢং ঢং করে রাত ১টা বাজল।  চিলেকোঠার ঘরে এখনো আলো জ্বলছে। ঋভু দা এখনো কাজ করছে? সিঁড়ি বেয়ে উঠে attic'র সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। এত রাতে নক করা কি ঠিক হবে? দরজার নিচ থেকে আলো দেখা যাচ্ছে।হালকা ধাক্কা দিতেই দরজাটা খুলে গেল। ঘরে সেই ল্যাম্পশেডটা জ্বলছে। ঋভু দা কাউচের উপর শুয়ে আছে। বুকের উপর বই,চশমাটা মাটিতে। সারা ঘর ছেঁড়া ছেঁড়া কাগজে ভর্তি। একটা খুলে সমান করে বুঝলাম ওটা ওর আঁকা একটা ডিজাইন। ঘরে এ.সির শীতল প্রবাহে কাঁটা দিচ্ছে শরীরে। চশমাটা তুলে আমি টেবিলে  রাখলাম। কাগজগুলো সমান করে টেবিলে গুছিয়ে রাখলাম। এই ডিজাইনগুলোও দরকার পড়তে পারে। ওর বুক থেকে বইটা তুলে গায়ে ব্ল্যাঙ্কেট দিয়ে দিলাম। ঋভু দা যে এত অগোছালো সেটা তো শুধু আমি জানি। ঋভু দা কতটা কাছের হয়ে থাকতে পারে সেটাও শুধু আমি জেনেছি। একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে পিছন ঘুরতেই ঋভু দা আমার বাঁ হাতটা ধরল। আমি চমকে উঠলাম। কি উষ্ণ ওর হাতটা! 

ঋভু দা ঘুমজড়ানো স্বরে ডাকল-"মিতুল!" কোথায় যেন একটা পড়েছিলাম , ভালোবাসার মানুষের ডাকা নাম যেন আদরের স্পর্শ মনে হয়। এই কি সেই অনুভূতি? আমি ঘাড় ঘুরিয়ে বললাম- "আ...মি শুধু.." ঋভু দা চোখ বুজেই হাসল । ওর হাতের উষ্ণতা আমার সারা শরীরে ছড়িয়ে যাচ্ছে। ঋভু দা উঠে বসে বলল- "এইদিকে এসো।"

আমি ওর পাশে গিয়ে বসতেই ও আমার কোলে মাথা রাখল। সত্যি বলছি আপেলটা যদি নিউটনের মাথায় না পড়ে ,উপরে আকাশের দিকে উঠে যেত, তাহলেও আমি এত চমকাতাম না। ঋভু দা কিন্ত নিরুত্তাপ। যেন ও মেপে নিতে চাইছে আমার শরীরে ক্রমবর্ধমান উষ্ণতা। "Five minutes. Let's  just Stay five minutes like this."- ঋভু দার গলার স্বর আমায় সম্মোহিত করছে মনে হচ্ছে। আমার অজান্তেই আমার হাত ওর মাথায় চলে গেল। কেন? কেন? 

ঋভু দার কপালের ভাঁজ সমান হয়ে গেছে। ও এখন হাসছে। সেই প্রিন্স মোডের হাসি। 

"ঋভু দা, কিছু হয়েছে তোমার?"-আমি জিজ্ঞেস করলাম।  ঋভু দা চোখ খুলে হেসে বলল- "Why do you think so? Isn't this something those male leads do in your favourite dramas?" 

"হ্যাঁ করে তো। কিন্তু তুমি তো ওদের মতন নয়। I think there's something bothering you."- আমি উত্তর দিলাম। 

"No, there was. এখন ঠিক হয়ে গেছে। কিন্তু why are you still up? It's quite late."-ঋভু দা কথা বলতে বলতে উঠে বসল। 

"আমি পড়ছিলাম। তুমি কিছু খাবে? I mean ..."- আমি মাটির দিকে তাকিয়ে বললাম। আর বেশিক্ষণ ওই চোখদুটোর দিকে তাকালে আমি...

"Let's cook Maggie."- ঋভু দা টেবিল থেকে চশমাটা নিয়ে পড়ল। ফেলে দেওয়া ডিজাইনগুলো টেবিলে দেখে ওর  মুখে একটা নরম হাসি ছড়িয়ে গেল। 

নীচে এসে ম্যাগি বানিয়ে খেলাম আমরা। রাত ২টোয় ম্যাগি! তাও ঋভু দার সাথে। খাওয়া শেষ হলে ঋভু দা আর আমি একসাথেই উপরে এলাম। 

ঋভু দা উপরে যাওয়ার আগে আমার মাথায় হাত রেখে বলল- "Thank you!" 

ঋভু দা সিঁড়ি দিয়ে উঠে গেলে আমি ঘরে চলে এলাম। আজ আর পড়া হবে না। বড্ড শান্তি লাগছে। কানে ভাসছে ঋভু দার ডাক। জানলাটা টেনে বন্ধ করতে গিয়ে দেখলাম আকাশের মেঘ সরে গেছে। আকাশজুড়ে চাঁদের আলো। ঋভু দা attic'র জানলায় এসে দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট ধরিয়েছে। ওর মুখে সেই হাসিটা লেগে আছে এখনো! জানলা আর বন্ধ করলাম না। আমার বিছানায় চাঁদের আলো এসে পড়েছে। ঋভু দার উষ্ণতা লেগে আছে গায়ে। ঋভু দাও তাহলে....